লাল রঙের দিন
শীতের হালকা রোদ্দুর পড়েছে বারান্দায়। কুয়াশা ধীরে ধীরে গা ছেড়ে সরে যাচ্ছে। ক্লাস সিক্সে পড়া শ্রী আজ সকাল থেকেই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছে। পেটটায় একটু টান লাগছে আর মেজাজটাও খারাপ লাগছে। মা বারবার ডাকছে, “শ্রী, দুধটা খেয়ে নে, স্কুলে যেতে হবে।” কিন্তু আজ কোনো কিছুই ভালো লাগছে না।
স্নানঘরে ঢুকে জামা খুলতেই শ্রী হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। তার নীল স্কার্টের নিচে একটা লালচে দাগ। ধাতস্থ হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। প্রথমে ভয়, তারপর অবাক হয়ে সে দেখতে থাকল দাগটা। কী হয়েছে ওর? রক্ত! কিন্তু কিভাবে?
“মা!”—একটা কাঁপা গলা শোনালো। মা ছুটে এলেন, “কি হয়েছে রে?”
শ্রী একটু লাজুকভাবে বলল, “মা, আমি... আমি রক্ত দেখেছি।”
মা বুঝে গেলেন। মুখে একটুও ভয় নয়, বরং একটুকরো হাসি খেলে গেল, “বড় হয়ে যাচ্ছিস রে শ্রী, এটা ভয় পাওয়ার কিছু না।”
শ্রী কিছু বুঝতে পারছিল না। তার চোখে জল, মনে হাজার প্রশ্ন। মা তাকে বাথরুম থেকে বার করে একদম কোলে টেনে নিলেন। “এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তোমার পিরিয়ড শুরু হয়েছে। এটা মানে তুমি এখন থেকে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছো। তোমার শরীরে নারীত্বের সূচনা হচ্ছে।”
শ্রী ফ্যালফ্যাল করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। মা বললেন, “আয়, তোর জন্য একটা পরিষ্কার ন্যাপকিন বের করে দিই।”
এরপর মা তাকে বসালেন। একটা পুরনো শাড়ি টেনে এনে শ্রী’র কোমরে প্যাড বাঁধলেন। “আজকাল though sanitary napkin পাওয়া যায়, তবু শুরুটা আমরা অনেক সময় বাড়ির পরিচিত উপায়ে করি। তুই যদি চাস, আমি তোকে শিখিয়ে দেব কীভাবে ব্যবহার করতে হয়।”
“মা, স্কুলে গেলে যদি কেউ দেখে?”
“তারা দেখবে না। তুমি যদি ঠিক মতো ব্যবহার করো, তাহলে কেউ টের পাবে না। আর মনে রাখিস, এটা কোনো লজ্জার বিষয় নয়।”
দুই দিন কেটে গেল।
শ্রী এখনো একটু কনফিউজড। স্কুলে গিয়ে সে দেখল ক্লাসের বড় মেয়ে রুম্পাও কোনো একদিন এমনই এক ঘটনা নিয়ে কথা বলছিল। আজ সাহস করে রুম্পার কাছে গিয়ে বলল, “তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?”
দু’জনে লাইব্রেরির পেছনে গিয়ে বসল। শ্রী ধীরে ধীরে তার ঘটনা বলল। রুম্পা হেসে বলল, “এটা তো একদম স্বাভাবিক। আমি তো অনেক আগে থেকেই পিরিয়ড সামলাতে শিখে গেছি। চাস তো, আমি তোকে প্যাড ইউজ করা, কাপড় বদলানো সব শিখিয়ে দেব।”
পরের দিন বিকেলে রুম্পার সঙ্গে শ্রী আর তার মা বাজারে গেল।
ওরা “মীনাক্ষী মেডিকেল” নামের দোকানে গিয়ে কিছু স্যানিটারি প্যাড কিনল। দোকানদার একবারও মুখ ঘুরিয়ে বা হাসি দিল না—মা বললেন, “ভালো করে দেখ, এমন দোকানদারদের খুঁজে নিতে হবে, যারা বুঝে পিরিয়ডের বিষয়টাকে সম্মান করে।”
মা আরও কিছু কথা বললেন শ্রীকে:
“এই সময়ে হাইজিন খুব জরুরি। দিনে অন্তত দুইবার প্যাড পাল্টাতে হবে। বেশি সময় রাখলে ইনফেকশন হতে পারে। প্যাড ব্যবহারের পর ওটা ভালো করে মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে হয়।"
"আর একদম ঝামেলা মনে হলে এখন মেনস্ট্রুয়াল কাপও পাওয়া যায়। তবে সেটা একটু বড় হয়ে ব্যবহার করিস।”
শ্রী ধীরে ধীরে সব বুঝতে শুরু করল। সে যেন এক নতুন পৃথিবীতে পা রাখল, যেটা ভয়ঙ্কর নয়, বরং শক্তিশালী।
এক মাস পর...
স্কুলে স্বাস্থ্য সচেতনতা শিবির বসেছে। এক নারী ডাক্তার এসেছেন কথা বলতে। তিনি বললেন,
“পিরিয়ড মানেই খারাপ কিছু নয়। এটা আমাদের শরীরের স্বাভাবিক চক্র। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলেই কোনো সমস্যা নেই। আমাদের উচিত পিরিয়ড নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা—না লুকিয়ে, না লজ্জা পেয়ে।”
ডাক্তার বললেন, “অনেক গ্রামে এখনো মেয়েরা পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে। সেটাও ঠিক আছে, যদি সেটা ভালোভাবে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেটা না করে যদি নোংরা কাপড় ব্যবহার করা হয়, তবে ইনফেকশন হতে পারে।”
শ্রী হঠাৎ হাত তুলল। “দিদি, পিরিয়ড চলাকালীন স্নান করা যায়?”
ডাক্তার হেসে বললেন, “অবশ্যই যায়। বরং গরম জলে স্নান করলে আরাম লাগে। পেট ব্যথাও কমে।”
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে শ্রী বলল, “মা, আমি চাই আমার পাড়ার মেয়েদেরও এসব জানানো হোক।”
মা বললেন, “তুই চাইলে একটা ছোট স্বাস্থ্য সচেতনতা ক্যাম্প করতে পারিস। আমি তোর সঙ্গে থাকব।”
দু’সপ্তাহ পর পাড়ার মাঠে ছোট্ট একটা ক্যাম্প বসে।
শ্রী আর রুম্পা মিলে পোস্টার বানায়—
“পিরিয়ড লজ্জার নয়, জ্ঞানের বিষয়”
“পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখো, স্বাস্থ্য ভালো রাখো”
“স্যানিটারি ন্যাপকিন বা পরিষ্কার কাপড়—যেটাই ব্যবহার করো, হাইজিন যেন ঠিক থাকে।”
প্রতিটি মেয়েকে শ্রী হাতে ধরে দেখায় প্যাড কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। ছোট বোন ঝিনুক, যে ক্লাস ফাইভে পড়ে, সে হেসে বলে, “আমি বড় হলে শ্রীদি-র মত হবো।”
শেষ দৃশ্য:
শীতের বিকেলে, এক টুকরো রোদে শ্রী বসে আছে নিজের বারান্দায়। তার হাতে একটা বই—“নারী শরীরের রহস্য।”
সে এখন আর ভয় পায় না। বরং সে গর্বিত যে সে নারী।
কারণ, নারী মানে শুধু কষ্ট না—নারী মানে জীবন শুরু করার শক্তি।
এই গল্পের বার্তা:
- পিরিয়ড লজ্জার নয়, জ্ঞানের বিষয়।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি।
- সবার উচিত সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া, বিশেষ করে কিশোরী মেয়েদের মধ্যে।
https://sukhsuluk.blogspot.com/
No comments
THANK YOU, PLEASE STAY WITH SUKHSULUK